ভ্যাসেকটমি
পুরুষদের স্থায়ী পদ্ধতি বা ভ্যাসেকটমি (Vasectomy)
পুরুষদের জন্মনিয়ন্ত্রণের স্থায়ী পদ্ধতিকে বলা হয় ভ্যাসেকটমি । ভ্যাসেকটমিতে ছোট অপারেশনের মাধ্যমে শুক্রবাহী নালীর কিছু অংশ বেঁধে কেটে ফেলে দিয়ে বা কটারী করে স্থায়ীভাবে সন্তান জন্মদানের ক্ষমতাকে বন্ধ করে দেয়া হয়। পুরুষদের স্থায়ী পদ্ধতি বাংলাদেশে ‘ভ্যাসেকটমি’ বা ‘পুরুষ-বন্ধ্যাকরণ’ নামে অধিক পরিচিত। ইদানিং ছুরি ব্যবহার না করে একটি ছোট ছিদ্র করে এই অপারেশনটি করার ফলে এটি নন স্কালপেল vasectomy বা ‘এনএসভি’ নামে পরিচিতি লাভ করেছে ।
স্থায়ী পদ্ধতির অপারেশন কোথায় করা হয়
স্থায়ী পদ্ধতি বিনা খরচে সকল সরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে, সরকার অনুমোদিত এনজিও এবং প্রাইভেট ক্লিনিকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ডাক্তার দ্বারা সম্পাদন করা হয় ।
দেশব্যাপী যে সকল হাসপাতালে/ক্লিনিকে টিউবেকটমি ও ভ্যাসেকটমি করা হয়ে থাকে-
- উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স
- মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র
- মান-উন্নিত ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র
- মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল এবং মডেল পরিবার পরিকল্পনা ক্লিনিক
- অন্যান্য সরকারি ও আর্মি হাসপাতালের এমসিএইচ-এফপি ক্লিনিক
- সরকার অনুমোদিত এনজিও এবং প্রাইভেট হাসপাতাল/ক্লিনিক
- সকল ইওসি কেন্দ্র (স্বাভাবিক প্রসবের পর ও সিজারিয়ান অপারেশনের সাথে প্রয়োজনে টিউবেকটমি করা হয়) এবং
- বিশেষ সেবা কার্যক্রম সংগঠনের মাধ্যমেঃ দূর্গম, দূরবর্তী, চর, কম অগ্রগতি সম্পন্ন এলাকায় এবং শহরাঞ্চলের বস্তিতে প্রতি উপজেলা/থানায় প্রতি মাসে কমপক্ষে ২ দিন বিদ্যমান স্থায়ী কেন্দ্রের বাহিরে (সাধারণত ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে, এনজিও ক্লিনিকে) বিশেষ ক্যাম্প সংগঠনের মাধ্যমে টিউবেকটমি ও ভ্যাসেকটমি সম্পাদন করা হয়ে থাকে ।
স্থায়ী পদ্ধতি গ্রহণের পর পূর্ববর্তী অবস্থায় ফিরিয়ে আনা বা পুনঃসংযোজন অপারেশন (Re-canalization operation) করা
টিউবেকটমি বা ভ্যাসেকটমি অপারেশনের পর প্রয়োজনে পুনঃসংযোজন অপারেশনের মাধ্যমে পুনরায় সন্তানধারণ ক্ষমতা ফিরিয়ে আনা যায় । পুনঃসংযোজন অপারেশনের সফলতার কোনো নিশ্চয়তা নেই । যত দেরিতে এই অপারেশন করা হবে সাফল্যের হার ততই কমে যাবে । কাজেই স্থায়ী পদ্ধতির “স্থায়ীত্ব ও অপরিবর্তনীয়তা” সম্পর্কে গুরুত্ব আরোপ করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ বিশেষ প্রয়োজন ।
বাংলাদেশে স্থায়ী পদ্ধতি গ্রহণের পর কোনো কারণে গ্রহীতার সকল সন্তান মারা গেলে, বিশেষ কারণে পুনঃবিবাহ হলে এবং সন্তান জন্মদানের বয়স থাকলে গ্রহীতা সন্তান নিতে ইচ্ছুক হলে সন্তান জন্মদানের ক্ষমতা ফিরিয়ে আনার জন্য সরকারি খরচে পুনঃসংযোজন অপারেশন করার ব্যবস্থা রয়েছে । বর্তমানে কয়েকটি হাসপাতালে মাইক্রো সার্জারির মাধ্যমে মহিলাদের ডিম্ববাহী নালী এবং পুরুষদের শুক্রবাহী নালী পুনঃসংযোজন করার ব্যবস্থা রয়েছে ।
এনএসভি যেভাবে কাজ করে
শুক্রকীট পুরুষের অন্ডকোষে তৈরি হয় এবং শুক্রবাহী নালী দিয়ে তা বীর্যথলিতে আসে ও জমা থাকে । বীর্যপাতের ফলে শুক্রকীট বীর্যের সাথে বের হয়ে আসে । এনএসভিতে শুক্রবাহী নালীর কিছু অংশ বেঁধে কেটে ফেলে দেওয়া হয় । এনএসভি পদ্ধতিতে ফ্যাসাল ইন্টারপজিশন করে শুক্রকীটবাহী নালীর এক প্রান্ত শীথের ভিতর এবং অন্য প্রান্ত শীথের বাইরে রাখা হয় । এর ফলে অন্ডকোষ থেকে শুক্রকীট শুক্রকীটবাহী নালী দিয়ে বীর্যথলিতে আসতে পারে না । ফলে বীর্যপাতের সময় শুধু বীর্য বের হয়, তাতে কোনো শুক্রকীট থাকে না । স্ত্রীর ডিম্বের সাথে শুক্রকীটের মিলন না হওয়ার কারণে গর্ভসঞ্চার হয় না ।
এনএসভির কার্যকারিতা বা সফলতার হার
ফ্যাসাল ইন্টারপজিশন করা হয় বলে পরিবার পরিকল্পনার সকল পদ্ধতির মধ্যে ভ্যাসেকটমি সবচেয়ে কার্যকর ও নিরাপদ পদ্ধতি। অপারেশনের পর প্রথম বছরে শতকরা ০.১৫ জন অর্থাৎ প্রতি ৭০০ জন ভ্যাসেকটমি গ্রহীতার মধ্যে ১ জনের স্ত্রী গর্ভবতী হতে পারে। ভ্যাসেকটমি অপারেশনের পর তিন মাস পর্যন্ত অন্য কোনো কার্যকর গর্ভনিরোধক পদ্ধতি ব্যবহার করা হলে শতকরা ০.০১ জন অর্থাৎ প্রতি ১০০০ জন ভ্যাসেকটমি গ্রহীতার মধ্যে ১ জনের স্ত্রী গর্ভবতী হতে পারে । ফ্যাসাল ইন্টারপজিশন না করা হলে ব্যর্থতার হার অনেক বেশি ।
এনএসভির বিফলতা বা ভ্যাসেকটমি গ্রহণের পর স্ত্রীর গর্ভধারণের কারণ
- স্ত্রী পূর্বেই গর্ভবতী হয়ে থাকলে ।
- অপারেশনের পরবর্তী ৩ মাস পর্যন্ত পরিবার পরিকল্পনার অন্য কোনো কার্যকর পদ্ধতি ব্যবহার না করে স্ত্রীর সাথে সহবাস করে থাকলে ।
- শুক্রবাহী নালীর কেটে দেয়া প্রান্ত দু’টি আপনাআপনি জোড়া লেগে গেলে ।
- ত্রুটিপূর্ণ অপারেশনের কারণে ।
- সঠিকভাবে ফ্যাসাল ইন্টারপজিশন না করার ফলে ।
এনএসভির সুবিধা
- স্থায়ী পদ্ধতি । প্রতিদিন ব্যব্হারের ঝামেলা থাকে না ।
- অত্যন্ত নিরাপদ ও কার্যকরী ।
- এনএসভি পদ্ধতিতে চামড়া কাটা লাগে না ফলে সেলাইও লাগে না, খুবই অল্প সময় লাগে (৫-৭ মিনিট) ।
- অল্প সময়ে ক্ষত সেরে যায় ।
- দীর্ঘমেয়াদি কোনো পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া বা কোনো স্বাস্থ্য ঝুঁকি নেই ।
- যৌন ও শারীরিক শক্তি কমে না এবং সহবাসে কোনো সমস্যা হয় না, আগের মতোই ঠিক থাকে ।
- পুরুষ হরমোন শরীরে আগের মত ঠিক থাকে, কারণ অন্ডকোষ পুরুষ হরমোন আগের মত তৈরি করে থাকে । ফলে পুরুষালীভাব ঠিক থাকে ।
- ব্যয় সাশ্রয়ী ।
- অপারেশন পরবর্তী তেমন বিশ্রামের প্রয়োজন হয় না ।
এনএসভির অসুবিধা
- স্থায়ী পদ্ধতি ।
- এ পদ্ধতি একবার গ্রহণ করলে আর সন্তান হবে না, তাই পদ্ধতি গ্রহণের পূর্বে চিন্তা ভাবনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া প্রয়োজন।
- পরবর্তীকালে গ্রহীতা সন্তান চাইতে পারে, এক্ষেত্রে পুনঃসংযোজন অপারেশনের প্রয়োজন হয়। এই অপারেশন খুবই জটিল, ব্যয়বহুল ও সহজপ্রাপ্য নয়। এই অপারেশনের সফলতার হার অনেক কম অর্থাৎ সফলতার কোনো নিশ্চয়তা নেই ।
- খুব ছোট হলেও এটি একটি অপারেশন এবং কম হলেও কিছুটা ঝুঁকি আছে ।
- সঙ্গে সঙ্গে কার্যকরী হয় না, কার্যকরী হতে কমপক্ষে ৩ মাস সময় লাগে । অপারেশনের পর ঐ ৩ মাস গ্রহীতাকে কনডম ব্যবহার করতে হয় বা স্ত্রীকে অন্য কোনো কার্যকর পদ্ধতি ব্যবহার করতে হয় ।
- প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ডাক্তার ও সাহায্যকারীর প্রয়োজন হয়।
- যৌনরোগ বা এইডস প্রতিরোধ করে না ।
এনএসভি (NSV- no scalpel vasectomy) বা ছুরিবিহীন ভ্যাসেকটমি
এই পদ্ধতিতে ছুরি বা সার্জিক্যাল ব্লেডের প্রয়োজন হয় না । সার্জিক্যাল ব্লেডের পরিবর্তে বিশেষভাবে প্রস্তুতকৃত সরু ও ধারালো ফরসেপের সাহায্যে অন্ডথলির মাঝরেখা বরাবর মাত্র একটি ছিদ্র করে উভয় পার্শ্বের শুক্রবাহী নালী বের করে এনে বেঁধে কেটে দেয়া হয় । ফলে কোনো সেলাই লাগে না এবং রক্তপাতও হয় না ।